জেদ্দা থেকে বিমান বাংলাদেশের বিজি ৩৩৬ ফ্লাইট বাংলাদেশে আসার সময় অসুস্থ বোধ করেন বিমানের যাত্রী প্রবাসী কবীর আহমেদ। ফ্লাইটের কেবিন ক্রুরা তার প্রাথমিক চিকিৎসার প্রস্তুতি নেন। এক চিকিৎসক যাত্রী কবীর দেখে জানান তার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। বিমান ল্যান্ড করার পর হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
বিমান কর্তৃপক্ষের অবহেলায় কবীর আহমেদে মৃত্যু হয়েছে অভিযোগ করে বিচার দাবি করেছেন কবির আহমেদের স্বজনরা
১৯৯৬ সাল থেকে সৌদি আরবে কাজ করেন তিনি। কবির আহমেদের ৩ সন্তান রয়েছে। বড় মেয়ে ১০ বছর বয়সী, ৭ বছর বয়সী দ্বিতীয় মেয়ে, সবার ছোট ১৮ মাস বয়সী ছেলে।
জানা গেছে, গত ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সময় জেদ্দা থেকে ছেড়ে আসে ফ্লাইটটি। ১৬ জানুয়ারি আনুমানিক বেলা ১১টার দিকে ঢাকায় অবতরণ করে। অবতরণের আগেই জরুরি ভিত্তিতে অ্যাম্বুলেন্স ও অ্যাম্বুলিফটের ব্যবস্থা রাখা ও মেডিক্যাল সাপোর্টের জন্য হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে জানানো হয়। বিমানবন্দরের স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা ১১টা ১০ মিনিটের দিকে কবীরের শারীরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করেন।
তবে উড়োজাহাজ থেকে কবীর আহমেদকে নামাতে অ্যাম্বুলিফট ও তাকে হাসপাতলে নিতে অ্যাম্বুলেন্স আসেনি তখনও। প্রায় ৪০ মিনিট পর উড়োজাহাজ থেকে কবীরকে নামিয়ে কুয়েত মৈত্রী হাসাপাতলে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ফ্লাইটের চিকিৎসক যাত্রী ছিলেন শমরিতা হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও ডা. এ বি এম হারুন। কেবিন ক্রুদের ডাকে সাড়া দিয়ে কবীর আহমেদের চিকিৎসায় সহায়তা করেন তিনি।
ডা. এ বি এম হারুন বলেন, ‘আমি ফ্লাইটে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম, কেবিন ক্রুরা কল করছেন, এই ফ্লাইটে কোনও ডাক্তার আছেন কি না। আমি সাড়া দিয়ে দেখি কবীর আহমেদের হার্ট ফেইলর হয়েছে। ফ্লাইটে থাকা মেডিক্যাল ইক্যুইপমেন্ট ও ওষুধ দিয়ে কবীর আহমেদকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেওয়া হয়। তাকে নেবুলাইজার দেওয়ার পাশাপাশি অক্সিজেনও দেওয়া হয়।’
ডা. হারুন বলেন, ‘আমি ফ্লাইটে থাকা ওষুধ দিলাম তাকে। কেবিন ক্রুরাও তাকে যথেষ্ট সাপোর্ট দিয়েছেন। পরে কবীরকে জরুরি চিকিৎসা দেওয়ার জন্য কাছের কোনও বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের বিষয়েও পরামর্শ দিই।’
তবে ইনিশিয়াল রুট চেকে (আইআরসি) থাকা পাইলট ইরফানুল হক যাত্রীর হার্ট অ্যাটাকের খবর পেয়ে ক্রুদের প্রাথমিক চিকিৎসার নির্দেশনা দেন। একই সঙ্গে ইরফানুল হক কাছাকাছি কোনও বিমানবন্দরে অবতরণ করতে প্রস্তাব করলেও ক্যাপ্টেন ফরিদ উজ্জামানের সম্মতি পাননি।
ডা. এ বি এম হারুন বলেন, ‘যাত্রীকে নিয়ে জরুরি অবতরণের বিষয়টিও আলোচনাও করেছিলাম। তখন পাইলটরা জানালেন এখন ভারতে আছেন, সেখানে নামতে জটিলতা আছে, আর কিছু সময় ফ্লাই করলে ঢাকায় নামা যাবে। ফ্লাইট থেকে নেমে যাওয়ার সময়ও দেখেছি সেই যাত্রী বেঁচে আছেন।’
১৬ জানুয়ারি হযরত শাজালাল আন্তর্জাতিক ব্মিানবন্দরে কবিরকে নিতে আসা তার ফুফাতো ভাই মো. ইসমাইল বলেন, ‘কবির ভাই ফ্লাইটে উঠে বাংলাদেশের সিম চালু করবেন বলেছিলেন। আমি বিমানবন্দরে তাকে রিসিভ করতে এসেছিলাম। কিন্তু তার কোনও ফোন না পেয়ে আমি তার মোবাইলে কল দিই। অনেক সময় ধরে রিং হলেও তিনি ফোন ধরেননি। ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশন, কাস্টমসে ব্যস্ত। পরে ১১টার দিকে একজন ফোন ধরে জানান, আমার ভাই অসুস্থ, আমাকে ৮ নম্বর গেটের কাছে আসতে বলেন তিনি। আমরা সেখানে এসে অপেক্ষা করি। কিন্তু কাউকে না পেয়ে আবারও কল করতে থাকি, কেউ ফোন ধরছিল না। ১২টার দিকে আবার কল করলে বলা হয়, আমার ভাইকে কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। আমি সেখানে গেলে জানায় আমার ভাই বেঁচে নেই। আমাদের তার ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয়।’
মো. ইসমাইল আরও বলেন, ‘আমার ভাইয়ের মৃত্যুর বিষয়টি আমরা এখনো পরিষ্কার না। তাকে ঠিকমতো চিকিৎসা দেওয়া হয়নি। তিনি বিমানেই মারা গেছেন কি না তা-ও পরিষ্কার না। আমরা এ ঘটনার বিচার চাই।’
সূত্রে জানা গেছে, গত ১৫ জানুয়ারি স্থানীয় সময়ে জেদ্দা থেকে আসা বিজি ৩৩৬ ফ্লাইটে পাইলট হিসেবে ক্যাপ্টেন ইরফানুল হকের ইনিশিয়াল রুট চেক (আইআরসি) ছিল। এ ফ্লাইটে পাইলট ইন কমান্ড (পিআইসি) এবং ট্রেইনি এক্সামিনার ছিলেন ক্যাপ্টেন দিলদার আহমেদ (জি-৫২৪৫৯)। সেই ফ্লাইটে পর্যবেক্ষণের জন্য বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) ফ্লাইট অপারেশন ইন্সেপেক্টর (এফওআই) ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান ছিলেন। তবে ৭৩ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন ফরিদ উজামানের পাইলট লাইসেন্স নেই।
ক্যাপ্টেন ইরফানুল হককে ককপিটে রেখে ক্রু রেস্ট বাঙ্কে চলে যান দিলদার আহমেদ তোফায়েল। এ সময় ককপিটে পাইলটের সিটে বসেন বেবিচকের ফ্লাইট অপারেশনাল ইন্সেপেক্টর (এফওআই) ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামান।
এভিয়েশন খাত-সংশ্লিষ্টরা যা বলছেন
একজন প্রশিক্ষণার্থী পাইলট ও একজন বৈধ পাইলট লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তির দ্বারা ফ্লাইট পরিচালনা বিমনা চলাচলের নীতিবহির্ভূত। এ ঘটনায় বিমানটি বিপজ্জনকভাবে পরিচালিত হয়েছে। অননুমোদিত ব্যক্তি দ্বারা পরিচালিত ফ্লাইট অবৈধভাবে পরিচালিত ফ্লাইট (ইলিগেল ফ্লাইট) হিসেবে গণ্য। এ ঘটনা বেবিচকের জন্য প্রচলিত বিধিবিধানের পরিপন্থী এবং বেসামরিক বিমান চলাচল আইন ২০১৭-এর ৩৩ ধারা অনুযায়ী অপরাধ।
এয়ারক্রাফট এক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন কমিটি অব বাংলাদেশের প্রধান ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এম রহমতউল্লাহ বলেন, ‘বৈধ পাইলট ছাড়া লাইসেন্সবিহীন ব্যক্তি কখনোই ককপিটে পাইলটের সিটে বসতে পারেন না। একই সঙ্গে ইনিশিয়াল রুট চেকে ট্রেইনি পাইলটকে দীর্ঘ সময় দায়িত্বে রেখে এক্সামিনার পাইলটের ককপিট ত্যাগ করা অনুচিত।’
এ প্রসঙ্গে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘পাইলট যে বাঙ্কে গিয়ে ঘুমিয়েছেন, এটা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ বাঙ্কে গিয়ে ঘুমিয়ে থাকার সুযোগ নেই। ওনার সঙ্গে আমার সরাসরি কথা হয়নি, তবে যতটুকু জানি, ওয়াশরুমে জামাকাপড় চেঞ্জের কোনও বিষয় হয়তো ছিল। জামাকাপড় চেঞ্জ করে আবার আসেন, কিন্তু গিয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন, এ ধরনের সুযোগ নেই। আর ফ্লাইটে যদি ট্রেইনি থাকে, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠে না।’
ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফরিদ উজ্জামানের বসা প্রসঙ্গে ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা তো আদৌ জানি না আসলেই তিনি (ফরিদ উজ্জামান) পাইলটের সিটে বসেছিলেন কি না, কন্ট্রোল প্যানেলে হাত দিয়েছিলেন কি না। তার যদি কোনও দোষ থাকে, তাহলে সিভিল এভিয়েশন দেখবে। আর ফ্লাইটে কোনও কিছু তো ম্যানুপুলেশনের সুযোগ নেই। ওনার এক সময়ে এই উড়োজাহাজের রেটিং ছিল। এখন ওনার বয়স বেশি হওয়ায় পাইলট লাইসেন্স নেই। এ উড়োজাহাজের যেকোনও বিষয়ে ওনি ভালো জানেন।’
এ বিষয় তদন্ত হচ্ছে কি না, জানতে চাইলে ক্যাপ্টেন সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়টি বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকও জানেন। বিমান ম্যানেজমেন্ট কিছু একটা করবে। আশা করি এটা নিয়ে অনুসন্ধান হবে।’
এর আগে ২০২১ সালের আগস্টে ওমানের রাজধানী মাস্কাট থেকে ঢাকায় আসার পথে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পাইলট নওশাদ আতাউল কাইউম অসুস্থবোধ করায় তাকে নিয়ে ফ্লাইটটি ভারতের নাগপুর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণ করেছিল। মহারাষ্ট্র রাজ্যের নাগপুর বিমানবন্দরে জরুরি অবতরণের পর তাকে দ্রুত ককপিট থেকে বের করে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। যদিও পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
একজন চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কেন নিকটস্থ কোনও বিমানবন্দরে অবতরণ করা হলো না, জানতে চাইলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আসলে সবকিছু ডিপেন্ড করে ওই সিচুয়েশনটা কেমন তার ওপর। আমি ডিটেইল জানি না সেখানে কী হয়েছে। কিন্তু ঢাকায় ফ্লাইট অবতরণের সময়ও যাত্রী বেঁচে ছিলেন। পরে হাসপাতলে নেওয়ার পর তিনি মারা গিয়েছেন।’
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশন্স) এয়ার কমডোর শাহ কাওছার আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘এ ঘটনাটি তদন্ত করে জানাতে বিমানকে বলা হয়েছে। তাদের প্রতিবেদন দেখে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রয়োজন হলে পরে আমরাও তদন্ত করবো।’